আমি একজন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারের বউ। বিয়ের বয়স খুব বেশিদিন হয় নি। এইতো ৪-৫দিন আগে মাত্র ১বছর শেষ হলো। জন্ম, বিয়ে, মৃত্যু তো সবার জীবনেই আসে তাই সবাই জানে এই তিনটি ধাপের অনুভূতি কেমন হয়! আনন্দ, স্বপ্ন আর বিষাদের ধাপ এই তিনটি। বিয়েকে ঘিরে সবার অন্যরকম এক আনন্দ আর স্বপ্ন কাজ করে। বিয়ের প্রথম ২-৩বছর হাসতে, খেলতেই পার হয়। আমি ২-৩ বছরের কথা বাদ দিলাম, বিয়ের প্রথম বছরটাই ধরি! আমি যদি অন্য কোনো পেশার মানুষকে বিয়ে করতাম তাহলে নিশ্চয় আমারও বিয়ের প্রথম বছরটা হাসতে খেলতে পার করতে পারতাম। কিন্তু আমি বিয়ে করেছি একজন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারকে, কোনো রক্ত মাংসের মানুষকে নয়!
এখন সবাই বলবে সব পেশার মানুষকেই কাজ করতে হয়। অনেকে উদাহরণ হিসেবে প্রবাসী, আর্মি, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, ডাক্তার ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক পেশা দেখাবেন। আমি কারো সাথে কোনো তর্কে যাবো না, শুধু আমার বিয়ের পর আমার স্বামীর জীবনযাপনের কিছু নমুনা তুলে ধরবো। বিয়ের সময় তার ছুটি ছিলো ৫দিনের। বিয়ের আগে পরে মিলিয়ে ৫দিনের। বিয়ের ১দিন পর থেকে তাকে দেখছি সে ফোনে ফোনে অফিস করছে। কিসের প্রোডাকশন, কিসের অপারেটর , কিসের কি ইত্যাদি ইত্যাদি হিসাব নিকাশ করছে!
বিয়ের ৫দিন কেটে গেলো। বিয়ের পর পর রমজান মাস আসলো। সেই মাসের প্রথম দিন অনেক অফিসেই তাদের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ছুটি দিয়ে দেয়। এই ছুটি বাধ্যতামূলক আমি সেটা বলছি না , কিন্তু অনেক অফিসই এই ছুটি দেয়। আর টেক্সটাইল সেক্টরে রোজার ছুটির দিনেও অফিস করতে হয়। তাদের ভাষায় একে বলে ‘জেনারেল’। ঈদের ছুটি আপনাকে ৭দিন দিবে তাই রোজার একমাস আপনাকে কাজ করতে হবে। কোনো ছুটি ছাটা নেই। আপনার একান্ত ছুটি লাগলে পার্সোনাল ছুটি থেকে কাটাবেন। স্বামীর সাথে ঘুরে ঘুরে ঈদ শপিং করার চিন্তা মাঠেই মারা গেলো!
টেক্সটাইল অফিসগুলো শুরু হয় সকাল ৮টায়। অফিসে আপনাকে আইডি কার্ড পাঞ্চ করতে হবে ঠিক ৮টায়। এক সেকেন্ড দেরি হলেই সেটা অফিস লেট বলে কাউন্ট হয়। এভাবে মাসে তিন দিন অফিস লেট হলে এক দিন এবসেন্ট বলে কাউন্ট হয় এবং বিনিময়ে একদিনের বেতন কর্তন করা হয়। ৮টায় অফিস তাই তাকে বের হতে হয় ৬.৪০এম -৬.৫০এমএর মধ্যে। তাদের গাড়ি ছাড়ে ৭.১০এম মিনিটে। যে মানুষটা বাসা থেকে বের হয় ৬.৪০এম-৬.৫০এম এর মধ্যে, সে একই মানুষ বাসায় ঢুকে ৯পিএম -৯.৩০পিএম এর মধ্যে।
বাসায় ঢুকেই তাকে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে যেতে হয়। কারণ পরদিন আবার সেই কাক ডাকা ভোরে তাকে উঠতে হয়। তার যে পরিবার আছে, পরিজন আছে তাদের সাথে সময় কাটাবে, সংসারের টুকিটাকি খোঁজ খবর নিবে সে সময় আছে ? সত্যি কথা যদি বলি এতো প্রেশার নেওয়ার পর একটা মানুষের ধৈর্য থাকে বাকি দুনিয়ার খোঁজ খবর নেওয়ার?
আমরা যারা চাকরি করি তাদের মে দিবস, শবে বরাত, লাইলাতুর কদর ইত্যাদি কত ছুটি রয়েছে। ওরাও ঐদিনে এই ছুটিগুলো পায় কিন্তু তার বিনিময়ে তাদের ছুটির দিনে অফিস করতে হয়। অচ্যুয়াললি তাদের কোনো ছুটিই নেই। কারণ প্রতিটা সরকারি অথবা উপলক্ষের ছুটি তাদের সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কাজের বিনিময়ে হয়।
এখন আসি অন্য প্রফেশন নিয়ে কিছু কথায়। যারা প্রবাসে থাকে তাদের জীবনও খুব কষ্টের। কিন্তু তারা যখন দেশে আসে ওই সময়টা কিন্তু শুধুই তাদের পরিবারের। যারা আর্মিতে আছে যতদূর জানি তাদেরও কয়েকমাস পর পর একটা লম্বা ছুটি দেওয়া হয়। কিন্তু যারা টেক্সটাইলে আছে তাদের লম্বা কোনো ছুটি নেই। সিক লিভ, এনুয়াল লিভ এই হাবিজাবি ১৫-১৯দিনের আছে ছুটি আছে শুধু। আর যতবাকি ছুটি নিবেন সেটা বেতনের বিনিময়ে। কথা হচ্ছে এই দেশে ইঞ্জিনিয়ার চাকরির শুরুর দিকে বেতনের যা অবস্থা থাকে, সেটার থেকে যদি আবার কেটে রাখে তাহলে তো কিছুই বলার নেই।
বর্তমানে দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে প্রবেশ করেছে। আর এক্ষেত্রে গার্মেন্টস শিল্পকে সর্বাগ্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
গার্মেন্টস শিল্পই বদলে দিবে বাংলাদেশকে। এখন আপনারা নিজেরাই বলেন যে শিল্প একাই একটা দেশকে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, সেই শিল্পের মানুষগুলোকে আমরা কতটা মানুষ হিসেবে মনে করছি?
আমাদের সরকার কতটা ভাবছে সেই মানুষগুলোকে নিয়ে? পোশাক শিল্পে নরমাল শ্রমিকরা যতটা স্বস্তি ফেলতে পারে, একজন ইঞ্জিনিয়ার তার সিঁকিভাগও শ্বাস ফেলতে পারে না। দেশের উন্নয়নে এতো বেশি ভূমিকা রেখেও এরা কিছুই পাচ্ছে না, উল্টো পরিবার থেকেও দূরে সরে যাচ্ছে। অন্য কোনো এক প্রফেশনের মতো এরাও পরিবার পরিজন রেখে দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। মাননীয় সরকার ভাবুন, এদের নিয়েও কিছু একটা ভাবুন। বড় কিছু করতে না পারেন, তারপরও সামান্য কিছু হলেও ভাবুন।
লেখক: ফারজানা আক্তার
ওয়েব ডেভেলপার ও সাংবাদিক।