১.
সাজিদ আর রিয়ার (ছদ্মনাম) বিয়ে হয়েছে মাত্র সাত মাস। এর মধ্যেই তাঁদের মধ্যে মতের অমিল, বিবাদ, কখনো হাতাহাতি। আট মাসের মাথায় বিবাহবিচ্ছেদের নোটিশ। শেষমেশ ডিভোর্স! যদিও দুজনের বিয়ে হয়েছিল টানা চার বছর প্রেম করে!
২.
রাকিব আর মৌয়ের (ছদ্মনাম) বেলায় বিষয়টি একটু আলাদা। রাকিব বিদেশে থাকেন। মৌ দেশে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। বিয়ের আগে কেউ কাউকে চিনতেন না-জানতেন না। দুই পরিবারের মধ্যে যোগাযোগ করে বিয়ে ঠিকঠাক। ধুমধামে বিয়ে হয়ে গেল। কোনো ঝগড়াঝাঁটি নয়, প্রকাশ্য বিবাদ বা হাতাহাতিও নেই, কিন্তু বিয়ের ছয় মাস পরই মৌ তাঁর মায়ের বাড়িতে চলে এলেন। রাকিবের সঙ্গে আর সংসার করবেন না। রাকিবও চান না তাঁদের বিয়ে টিকে থাকুক। দুজনের সম্মতিতে তিন মাসের মধ্যেই ডিভোর্স কার্যকর হলো।
বিয়ে দুজন মানুষের মধ্যে একটি সামাজিক ও আইনি চুক্তিবিশেষ। দুটি পরিবারের মধ্যে সামাজিক বন্ধনও। বিয়ে সব সময় যে সফল হবে, রূপকথার গল্পের মতো সব দম্পতিই যে ‘সুখে শান্তিতে দিন কাটাতে’ পারবে, তা নয়। মতের অমিল হলে বা মনের অমিল চরম পর্যায়ে পৌঁছালে, নিপীড়ন আর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় কখনো বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। বিচ্ছেদ কখনোই কাঙ্ক্ষিত নয়, তবে কখনো অবধারিত এবং মানসিক যন্ত্রণা কমাতে ইতিবাচকও হতে পারে। এটি মোটেই নিষিদ্ধ বিষয় নয়, সম্পর্কের অবনতির ক্ষেত্রে এটি স্বাভাবিক পরিণতি। মাঝে মাঝে দেখা যায়, বিয়ের অল্প কিছুদিন না যেতেই ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১৭ সালে বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন®করা পুরুষের হার ছিল ১.৫ শতাংশ আর নারীদের মধ্যে এই হার ছিল ১০.৫ শতাংশ। গত সাত বছরে বিবাহবিচ্ছেদের প্রবণতা বেড়েছে ৩৪ শতাংশ (বিবিএস ২০১৮)। পত্রিকায় প্রকাশিত গবেষণালব্ধ তথ্যমতে, শুধু ঢাকা সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত এলাকায় প্রতি ঘণ্টায় ১টি করে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন হচ্ছে—এর মধ্যে ৯৫ শতাংশেরই বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকর হয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় দেখা যায়, গড় হিসাবে বেশির ভাগ বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে বিয়ের আট বছরের মাথায়। তবে দিন দিন সময়ের এই ব্যবধান কমে আসছে, অর্থাৎ বিয়ের পরপর বিচ্ছেদের হার বাড়ছে। ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অস্টিনের গবেষক টেড হিউস্টন এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, বিয়ের প্রথম দুই বছর হচ্ছে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এই দুই বছরের মধ্যেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ডিভোর্সের ঘটনা ঘটে।
বিয়ের পরপরই ডিভোর্স
বিয়ের আগে প্রত্যেক নারী-পুরুষের কিছু নিজস্ব বিষয় থাকে। তা সেটা প্রেমের বিয়েই হোক বা পারিবারিকভাবে বিয়েই হোক। জীবনে তাঁদের ভূমিকার পরিবর্তন হয়। এই ভূমিকা পরিবর্তনের বিষয়টি দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিতে হয়। এই সময় আরেকজনের সঙ্গে ও আরেকটি পরিবারের সঙ্গে মানিয়ে চলার সমস্যা হয়। তখন ধৈর্যের অভাব, ব্যক্তিত্বের সংঘাত আর আনুষঙ্গিক কিছু বিষয় বিচ্ছেদের কারণ হতে পারে।
বিয়ের এক বছরের মধ্যে বিচ্ছেদ হওয়ার যেসব কারণ গবেষণায় উঠে এসেছে—
বিশ্বাস-অবিশ্বাস ও প্রতারণা: বিয়ের পরপরই যদি যেকোনো একজনের অবিশ্বস্ততা আর প্রতারণার বিষয় প্রকাশ পায়। ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে প্রতারণা, পেশা নিয়ে প্রতারণা ইত্যাদি হতে পারে। বিয়ের আগের পুরোনো সম্পর্ক আবার নতুন করে তৈরি হওয়া, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, বিবাহ–বহির্ভূত সম্পর্ক অনেক সময় বিচ্ছেদের কারণ হয়ে যায়।
যৌন সমস্যা:
বিয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য বিষয় যৌনতা। বিয়ের পরপরই যদি দেখা যায়, একজনের মধ্যে গুরুতর যৌন সমস্যা বা কোনো বিকৃতি (পারভার্সন) আছে, তখন দ্রুত বিচ্ছেদ ঘটে।
মাদক সমস্যা:
বিয়ের পরপর যদি আবিষ্কার হয় কেউ মাদকাসক্ত, তখন মাদকাসক্তির কারণে তাঁর আচরণের পরিবর্তন হয়, যৌন সমস্যা বাড়ে, আর্থিক অসচ্ছলতা দেখা দেয়—যা দ্রুত বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ। মাদকের পাশাপাশি প্রযুক্তি–আসিক্ত এবং প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সূত্র ধরে সম্পর্কের জটিলতা হতে পারে।
‘এ তো তুমি নও’:
বিয়ের আগে যাঁকে চিনতেন, বিয়ের পরে তাঁকে যেভাবে পেতে চেয়েছিলেন, দেখা গেল তিনি তেমনটা নন। অর্থাৎ আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বাস্তবতার মিল না থাকায় একটা ধাক্কা খেতে হয়। সেখান থেকে বিচ্ছেদের সূত্রপাত হয়।
‘আমাকে বোঝে না’:
ও আমাকে বুঝতে চায় না। আমার আবেগকে মূল্য দেয় না—এ ধরনের অভিযোগ পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ককে নষ্ট করে। পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাব বিচ্ছেদকে ত্বরান্বিত করে। যোগাযোগের ঘাটতিতে অনেক সময় এ রকম মনে হয় যে আরেকজন আমাকে বোঝে না।
বেকারত্ব:
বিয়ের পরপর বেকার হয়ে যাওয়া, অর্থনৈতিক চাপ বেড়ে যাওয়া এবং আর্থিক সংকট ও ঋণ দুজনের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি করে এবং বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে দেখা দেয়।
তৃতীয় পক্ষের যুক্ত হওয়া:
অনেক সময় দেখা যায়, দুজনের সম্পর্কের মধ্যে পরিবারের অন্য কোনো সদস্য নাক গলিয়ে অযথা জটিলতা তৈরি করছে। এই তৃতীয় পক্ষ হয়তো ভালো করতে গিয়ে প্রকারান্তরে খারাপ করে ফেলছে। তিনি হয়তো ভালো মনে করে কিছু পদক্ষেপ নিলেন, কিন্তু তা ভালো না হয়ে খারাপ হয়ে যায়।
দূরে থাকা:
বিয়ের পর দুজনে একসঙ্গে না থেকে দূরে দূরে থাকলে সম্পর্কের গভীরতা তৈরি হয় না। তখন সামান্য ঘটনায় ডিভোর্স হয়ে যায়।
কী করণীয়
বিয়ের পর দুজনের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়াটা খুবই দরকার—এমনকি যদি আগে থেকেও বহুদিনের চেনাজানা ও প্রেম থেকেও থাকে। কারণ, বিয়ে হচ্ছে একটি পরিবর্তনের সন্ধি। বিয়ের মাধ্যমে প্রত্যেকের মনোজগতে পরিবর্তন ঘটে। আগে যে ভূমিকায় কখনো ছিলেন না, সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। এ সময় একটি মানসিক চাপ তৈরি হয়। হোমস ও রাহে ১৯৬৭ সালে তাঁদের বিখ্যাত স্ট্রেস স্কেলের প্রচলন করেন। সেখানে ৪৩টি লাইফ ইভেন্টের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, যেগুলো আমাদের মধ্যে মানসিক চাপ বা স্ট্রেস তৈরি করে। সেখানে সঙ্গী/সঙ্গিনীর মৃত্যুকে ১ নম্বর মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী ঘটনা বলা হয়েছে, ২ নম্বরে আছে ডিভোর্স। আর জেনে আশ্চর্য হবেন যে ৪৩টি বিষয়ের মধ্যে ৭ নম্বরে আছে বিয়ে! এর অর্থ, বিয়ে পছন্দের মানুষের সঙ্গে হোক বা অপছন্দের জনের সঙ্গে, এটি মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী একটি বিষয়। তাই বিয়ের পর মানসিক চাপে থাকা প্রত্যেক নারী–পুরুষই খানিকটা অধৈর্য হয়ে থাকেন। আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। তখন অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করে ফেলেন, যা কোনো কোনো সময় ডিভোর্সে পর্যবসিত হয়। ডিভোর্স এড়াতে সুখী জীবনযাপনের জন্য যা করা যেতে পারে—
ধৈর্য ধরতে হবে:
পরস্পরকে দোষারোপ না করে ধৈর্য ধরে একে অপরকে বুঝতে হবে। তড়িঘড়ি করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।
যৌন সমস্যার চিকিৎসা:
পুরুষ বা নারী, উভয়ের যে কারও যৌন সমস্যা থাকতে পারে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোনো দুর্বলতা বা অসুবিধা থাকলে বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। নিয়মিত শারীরিক মেলামেশা সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য সহায়ক।
তৃতীয় পক্ষকে সুযোগ দেওয়া যাবে না:
নিজেদের সমস্যা সমাধানে অপরকে হস্তক্ষেপের সুযোগ দেওয়া যাবে না। নিজেদের সমস্যা নিজেদেরই সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে হবে।
কার্যকরী যোগাযোগ:
দুজনের মধ্যে কার্যকরী যোগাযোগ তৈরি করতে হবে। নিজেদের না বলা কথাটুকু বুঝে নিতে হবে। যোগাযোগের ঘাটতি ভুল–বোঝাবুঝি বাড়াবে ও ডিভোর্সের দিকে ঠেলে দেবে।
জবাবদিহি ও খোলামেলা:
গোপনীয়তা সন্দেহের একটি কারণ। প্রত্যেকের নিজস্বতা থাকবে। কিন্তু স্পর্শকাতর বিষয়গুলো গোপন করতে থাকলে অবিশ্বাস বাড়বে। বিচ্ছেদের ঝুঁকিও বাড়বে।
আগেই সন্তান নয়:
পরস্পরের মধ্যে বিবাদ, ভুল–বোঝাবুঝি দেখা দিলে পরিবারের সদস্যরা অনেক সময় সন্তান নেওয়ার পরামর্শ দেন, যা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ও ভুল। সম্পর্ক মজবুত না করে সন্তান নেওয়া ঠিক নয়। এতে জটিলতা আরও বাড়ে।
আর্থিক ব্যবস্থাপনা:
বিয়ের পর খরচের গতিপ্রকৃতির পরিবর্তন হয়। এ সময় সুশৃঙ্খলভাবে আর্থিক ব্যবস্থাপনা আর পরিকল্পনা করা দরকার, না হলে মানসিক চাপ আরও বাড়ে।
কাজগুলো ভাগ করে নেওয়া:
ঘরের আর বাইরের কাজগুলো করার সময় পরস্পরের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। ‘এটি আমার কাজ’, ‘এটি তোমার কাজ’, ‘আমি এটি কেন করব’ ইত্যাদি এড়িয়ে চলতে হবে।
রাগ নিয়ন্ত্রণ ও মনের যত্ন:
মনের যত্ন নিতে হবে, নিজেকে সময় দিতে হবে। রাগ নিয়ন্ত্রণের কৌশলগুলো রপ্ত করতে হবে। মনের জন্য ক্ষতিকর কাজ—মাদকাসক্তি, রাতজাগা ও প্রযুক্তিতে অতি আসক্তি এড়িয়ে চলতে হবে। পরস্পরকে গুণগত সময় দিতে হবে।
প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ:
সম্পর্ক নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হলে প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে সমস্যার সমাধান করা প্রয়োজন।
বিচ্ছেদের কিছু কারণ
খরচের বিষয়ে সিদ্ধান্তে না আসা:
সংসারের সম্মিলিত খরচ ও দুজনের ব্যক্তিগত আয়-ব্যয়ের বিষয়ে একমত না হওয়া এবং টানাপোড়েন লেগে থাকা। এই আর্থিক ইস্যুতে শুরু হওয়া মতবিরোধ বিচ্ছেদে রূপ নেয়।
সংসারের দায়িত্ব ভাগ করে না নেওয়া:
সংসারের দায়িত্বগুলো ভাগ করে না নেওয়ায় কারও ওপর বাড়তি চাপ পড়ে, যেটি বিবাদের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা দেয়।
ছোটখাটো সৌজন্যবোধের ঘাটতি:
বিয়ের পরপরই কিছু আকাঙ্ক্ষা থাকে জীবনসঙ্গী বা জীবনসঙ্গিনীর কাছে। সাধারণ সৌজন্যবোধ না দেখানো বা ছোটখাটো উপহার দেওয়া না–দেওয়া—এ রকম ছোটখাটো ইস্যুর কারণে বিবাদ, মনের অমিল আর পরস্পরকে দোষারোপ করা শুরু হয়। আর সেখান থেকে বিচ্ছেদ।
দম্পতি হিসেবে নিজেদের প্রকাশ না করা:
দুজন মিলে একসঙ্গে দম্পতি হিসেবে নিজেদের প্রকাশ করতে না পারা, অর্থাৎ সব সময় আলাদা আলাদা থাকা দুজনের মধ্যে দূরত্ব বাড়ায়।
বিরক্তিকর আচরণ:
সঙ্গী বা সঙ্গিনীর অপছন্দের কাজগুলো বারবার করা বা সেসব সংশোধন না করা।
যৌক্তিকভাবে আচরণ করতে না পারা:
দাম্পত্য কলহ বা বিবাদ কখনোই কাম্য নয়। কিন্তু অনেক সময় কোনো বিষয়ে দ্বিমত থাকলে যৌক্তিকভাবে আলোচনা করতে হয়। এই যৌক্তিক আলোচনার বদলে অযৌক্তিক কলহ পরবর্তী সময়ে বিচ্ছেদে রূপ নিতে পারে।
আহমেদ হেলাল
সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা