লেবাননের রাজধানী বৈরুতের রাস্তায় তপ্ত গরমের মধ্যে মেয়েকে কাঁধে শুইয়ে রেখে গাড়িতে গাড়িতে কলম বিক্রি করা সিরিয়ার সেই শরণার্থী আবদুল হালিম আল-আত্তার এখন তিনটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। শুধু তাই নয়, তার এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করছে সিরিয়ার আরও ১৬ জন শরণার্থী।
তার এই প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে: একটি বেকারি, একটি কাবাবের দোকান এবং একটি ছোট্ট রেস্টুরেন্ট।
দীর্ঘদিন ধরে চলা গৃহযুদ্ধে অনেক সিরীয় ইতিমধ্যে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন এবং হচ্ছেন। তারা ভাগ্যের অন্বেষণে বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে প্রধানত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঢোকার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ ঢুকেছেনও। কিন্তু এখানেও তাদের জীবনের নিশ্চয়তা মিলছে না। জীবিকার তাগিদে তারা সেখানে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজ করছেন। তেমনি এক বাবার ছবি এসেছিল গণমাধ্যমে, যিনি তার ঘুমন্ত ছোট্ট মেয়েকে কাঁধে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় কলম বিক্রি করছিলেন।
তার কলম বিক্রির একটি ছবি ওয়েব দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর তার নামে একটি ফান্ড গঠন করা হয় এবং সেই ফান্ডের সহায়তায় তিনি তার তিনটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন।
নরওয়ের সিজার সিমোনারসন নামে একজন অনলাইন সাংবাদিক ও ওয়েব ডেভেলপার তার সাহায্যার্থে টুইটারে একটি অ্যাকাউন্ট খুলে বসেন। ‘বাই পেনস এন্ড ইনডিগোগো ক্যাম্পেইন টু রাইজ ৫০০০ ডলার ফর আল-আত্তার এন্ড হিজ ফ্যামিলি’ নামের ওই অ্যাকাউন্টটি যখন তিন মাস পর বন্ধ করা হয় ততক্ষণে এতে জমা পড়ে যায় এক লাখ ৮৮ হাজার ডলারের বেশি।৩৩ বছর বয়সী বাবা আল-আত্তার ওই টাকা থেকে ২৫ হাজার ডলার সিরিয়ায় তার বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের দিয়ে দেন। বাকি টাকা থেকে একটি বেকারি খুলেন। পরবর্তীতে আরেকটি কাবাবের দোকান ও একটি ছোট রেস্তোরাঁ খোলেন। এখানে তিনি কাজ দিয়েছেন তারই মতো উদ্বাস্তু হয়ে আসা ১৬ সিরীয়কে।
আল-আত্তার বলেন, এ টাকায় শুধু আমার জীবনই পরিবর্তিত হয়নি, আমার সন্তানদের জীবনও পরিবর্তিত হয়েছে। আল-আত্তারের জীবনে এখন সাচ্ছন্দ্য ফিরে এসেছে। তিনি সিরিয়া থেকে তার স্ত্রীকেও বৈরুতে নিয়ে এসেছেন। এখানে তারা এখন স্থায়ী হয়েছেন।
বৈরুতে তিনি এখন দুই রুমের একটি বাসায় বসবাস করছেন। ৪ বছরের রিমি যে বাবার কাঁধে ঝুলে ছিল সেও এখন নতুন নতুন খেলনা পাচ্ছে। তার ৯ বছর বয়সী ভাই আব্দুল্লাহ তিন বছর পর আবার স্কুলে যাচ্ছে।
এর আগে আল-আত্তার দামেস্কের ইয়ারমুকে একটি ফিলিস্তিনী শরণার্থী শিবিরের চকলেট কারখানায় কাজ করতেন। বিমান হামলায় সেটি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরই তার দুর্ভোগ শুরু হয়। যদিও তিনি সিরিয়া থেকে এসেছেন কিন্তু তিনি মূলত ফিলিস্তিনী। তার সিরীয় নাগরিকত্ব নেই।
সংগৃহীত টাকা আল-আত্তারের কাছে পৌঁছানোটাও ছিল একটি দুরূহ কাজ। তিনি পেয়েছেন ১ লাখ ৬৮ হাজার ডলারেরর মাত্র ৪০ শতাংশ টাকা। এ টাকা পৌঁছাতে ইনডিগোগো ও পেপলকে দিতে হয়েছে ২০ হাজার ডলার প্রক্রিয়াকরণ ও ব্যাংক ফি। তাও লেবাননে তাদের ব্যবসা না থাকায় দুবাই থেকে এ টাকা সংগ্রহ করতে হয়েছে। সংগ্রহ অভিযানে অংশগ্রহণকারী একজন বন্ধুর মাধ্যমে তা লেবাননে পৌঁছানো হয়।
সিমোনারসন বলেন, যখন আমি দেখলাম তিনি একটি রেস্তোরাঁ খুলেছেন এবং তার শিশুরা ভালো যতœ-আত্তি পাচ্ছে তখন আমার খুবই ভালো লাগছে। কিন্তু লেবাননের উদ্বাস্তুদের কাছে ফান্ড পৌঁছাতে যে কত কষ্টকর ও জটিল পথ অতিক্রম করতে হয়েছে তাতে আমি খুবই মর্মাহত হয়েছি। লেবাননে উদ্বাস্তুদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার কোনো অধিকার নেই।
জটিলতার কারণে সব টাকা এখনো হাতে পাননি আল-আত্তার। তবুও তিনি খুশি। এ টাকায়ই তিনি বিনিয়োগের মাধ্যমে সামনে এগিয়ে যেতে চান। একসময়ের রাস্তার হকার আল-আত্তার এখন নিজেকে সেই সমাজেরই একজন গর্বিত সদস্য মনে করেন।
ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের ২০১৪ সালের তথ্য মতে, লেবাননে ১২ লাখ নিবন্ধিত সিরীয় উদ্বাস্তু রয়েছে। তাদের অনেকেই কাজের জন্য সংগ্রাম করছেন। কেবল এক-তৃতীয়াংশ কাজের সুযোগ পেয়েছেন মাত্র। বাকিরা হন্যে হয়ে কাজের খোঁজে ঘুরছেন।
সূত্র : দ্য টেলিগ্রাফ, ওয়াশিংটন পোস্ট, এনডিটিভি।